ট্রেনের টিকিট বিক্রির নামে প্রতারণা, যাত্রীরা ক্ষতির সম্মুখীন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাত্রীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সিলেট, শ্রীমঙ্গল বা কক্সবাজারগামী ট্রেনের টিকিট যাত্রার ৯-১০ দিন আগেও পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতি একদিকে যাত্রীদের জন্য ভোগান্তি তৈরি করছে, অন্যদিকে সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে এসব প্রতারকরা ট্রেনের টিকিট বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে ট্যুরিস্ট গন্তব্যের ফেসবুক গ্রুপগুলোতে তারা নিজেদের বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, টিকিট পাওয়া যাবে। আগ্রহীরা হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ করলে তারা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে কথা বলে এবং অগ্রিম টাকা দাবি করে। টাকা পাঠানোর পরপরই প্রতারকরা নম্বর ব্লক করে দেয়, ফলে যাত্রীরা আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না।

এ ধরনের প্রতারণা শুধু সিলেট বা কক্সবাজারে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অহরহ ঘটছে এমন প্রতারণার ঘটনা। এই চক্রের কর্মকাণ্ড রোধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া, শুধু প্রতারণাই নয়, রেলের টিকিটের আরেকটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কালোবাজারি। বিশেষ করে উৎসবের সময় ট্রেনের টিকিটের চাহিদা বাড়ে, এবং এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে টিকিট কালোবাজারি চক্র। তারা সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় অনেক বেশি দামে টিকিট বিক্রি করে।অনেক সময় এই কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তবে, সাক্ষীর অভাবে এবং বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে অভিযুক্তরা শেষ পর্যন্ত দায়মুক্তি পেয়ে যান।আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব মামলার প্রমাণ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে থাকে এবং পুলিশের পাশাপাশি পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগও এতে সংশ্লিষ্ট থাকে। তবে গুরুতর অপরাধের মামলায় সাক্ষীর নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিধিমালার বাইরে অন্য কোনো আইনে সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই, ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান, যার ফলে অপরাধীরা খালাস পেয়ে যায়।

রেলের ই-টিকিটিং সিস্টেম (রেলসেবা অ্যাপ) চালু হওয়ার পরও টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হয়নি। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কৌশলে একটি চক্র জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসা চালাচ্ছে। কালোবাজারিরা সোশ্যাল অ্যাপ এবং সরাসরি দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছে। এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা ভোটার তালিকা ও ফটোকপির দোকান থেকে এনআইডি নম্বর সংগ্রহ করে এবং প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার টিকিট বিক্রি করছে।

এদিকে, ট্রেনে যাত্রী হয়রানি ও প্রতারণা প্রতিরোধে বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীদের নিজেদের নির্ধারিত মোবাইল অ্যাপ ‘রেল সেবা’ ব্যবহার করে টিকিট কেনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিকিট বিক্রির নামে যেসব প্রস্তাব দেখানো হয়, সেগুলোর অধিকাংশই প্রতারণা। এসব প্রতারক বিকাশ, নগদ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ফলে অনেক যাত্রী প্রতারণার শিকার হন।

রেল সূত্রে জানা গেছে, একটি রেজিস্টার্ড আইডি থেকে এক যাত্রায় সর্বোচ্চ ৪টি টিকিট কেনা যাবে, এবং টিকিটের ক্ষেত্রে আইডিধারীর সহযাত্রীদের নাম ইনপুট করা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ট্রেনের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রয় করা হচ্ছে এবং শুধুমাত্র বাংলাদেশ রেলওয়ের নির্ধারিত অ্যাপ ‘রেল সেবা’ থেকেই টিকিট কেনা যাবে। রেল কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, রেল সেবা ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিকিট কেনা হলে প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রেলওয়ের নিয়ম অনুসারে, যে ব্যক্তির আইডি ব্যবহার করে টিকিট কেনা হয়েছে, ওই ব্যক্তিকেই মোবাইল ফোন ও ফটোযুক্ত আইডি কার্ডসহ ভ্রমণ করতে হবে। আইডিধারী ও টিকেটে উল্লিখিত সহযাত্রী ব্যতীত অন্য কেউ ভ্রমণ করলে তা আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ। যদি কোনো প্রতারক অন্য কারো আইডি ব্যবহার করে টিকিট সংগ্রহ বা বিক্রির চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে।

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) ও রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) এ বিষয়ে সহায়তা করছে। সন্দেহ হলে বা প্রতারণার শিকার হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের হটলাইন ১৩১ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে; সব ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে। টিকিট কেনার সময় সরকারি নির্ধারিত অ্যাপ ছাড়া অন্য কৃত্রিম প্রস্তাব বা তৃতীয় পক্ষের সাহায্য গ্রহণ এবং কোনো সন্দেহজনক অফার দেখা মাত্রই তা রিপোর্ট করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ সকল যাত্রীকে অনুরোধ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *