প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশ থেকে অসহায়ভাবে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশি কর্মীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভালো বেতনের চাকরির আশায় প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে শত শত মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে বাস্তবে, অনেকেই দালাল এবং অনিয়ন্ত্রিত রিক্রুটিং এজেন্সির ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন খালি হাতে। শুধু অর্থের ক্ষতি নয়, অনেক কর্মী মানবেতর জীবনযাপন শেষে হতাশা নিয়ে দেশে ফিরছেন।

সম্প্রতি, কিরগিজস্তান, দুবাই, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত বাংলাদেশি কর্মী প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর কিরগিজস্তান থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন ১৮০ জন বাংলাদেশি। তাদের গার্মেন্টস ও নির্মাণ খাতে ভালো বেতনের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা কাজ পাননি, বেতনও পাননি। অনেকেই নথিপত্রহীন হয়ে পড়েছেন এবং কিছু কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমনকি মুক্তিপণ চেয়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও এবং দালালদের প্রলোভনে পড়ে মানুষগুলো বিদেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা প্রতারণার শিকার হন। তিনি বলেন, “বিদেশে বেশি বেতনের কাজের লোভ দেখানো হলেও বাস্তবে গিয়ে তারা কাজ পাননি এবং বেতনও পাননি। অনেকেই নথিপত্রহীন হয়ে পড়েছেন, আবার অনেকের পরিবারকে মুক্তিপণ দিতে হয়েছে।”

ভুক্তভোগীরা জানান, দালালরা তাদের ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তারা বাস্তবে আটকা পড়েন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। কাজ না পেয়ে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন, আবার কিছু কর্মী জিম্মি হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। অনেককে সীমান্তবর্তী এলাকায় আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়, আবার কেউ কেউ অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে গ্রেপ্তার হন।

এদিকে, ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে ফেরত আসা ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে মাত্র ৪০ জন প্রবাসীকে বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ বিদেশে যান, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই দালাল ও অনিয়ন্ত্রিত এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদেশগামী কর্মীদের সুরক্ষায় নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু নীতিমালা নয়, তার বাস্তবায়ন এবং নজরদারি জোরদার না হলে প্রতারণা বন্ধ হবে না। দালালচক্র ও অনিয়ন্ত্রিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, বিদেশে যাওয়ার আগে তাদের মাসে ৬০০ ডলার বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেখানে গিয়ে কাজ না পেয়ে তারা খালি হাতে দিন কাটাতে বাধ্য হন। কিছু কর্মীর পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, এবং তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশগামী কর্মীদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগ, দালালচক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান এবং ভুক্তভোগীদের জন্য দ্রুত প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেন, বিদেশে যাওয়ার আগে কর্মীদের সঠিক তথ্য এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা জানান, যদিও বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য চাহিদা রয়েছে, তবে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। তারা মনে করেন, বিদেশগামী কর্মীদের জন্য সরকারি পর্যায়ে তথ্যকেন্দ্র ও হেল্পলাইন আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এতে দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, বিদেশে কর্মীদের সুরক্ষায় গন্তব্য দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের আশায় দালালচক্র ও এজেন্সির ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। যদি প্রতারণা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এ প্রবণতা আরও বাড়বে এবং দেশের শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

One thought on “প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশ থেকে অসহায়ভাবে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশি কর্মীরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *