বিশেষ প্রতিবেদক
চলতি বছর দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই নয় মাসে সারাদেশে ৬৬৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৩৯৭ জনই শিশু। গড়ে প্রতি মাসে ৭৩টির বেশি ধর্ষণ এবং প্রতিদিন দুজনের বেশি নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা ও পুলিশের তথ্যে উঠে এসেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে প্রায় ১,৮৭৯টি মামলা এবং প্রতিদিন ৬০টির বেশি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
শিশু নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক
মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু। গত সেপ্টেম্বর মাসেই ১৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৫ জন ধর্ষণের শিকার এবং এর মধ্যে ৩০ জন (৫৪%) ছিল ১৮ বছরের নিচে।

আরও ভয়াবহ হলো—চলতি বছরে ২০ জন ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন এবং ৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
পুলিশের পরিসংখ্যান: মাসওয়ারি চিত্র
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী:
- জানুয়ারি: ১,৪৪০টি মামলা
- ফেব্রুয়ারি: ১,৪৩০টি
- মার্চ: ২,০৫৪টি
- এপ্রিল: ২,০৮৯টি
- মে: ২,০৮৭টি
- জুন: ১,৯৩৩টি
- জুলাই: ২,০৯৭টি
- আগস্ট: ১,৯০৪টি মামলা
সব মিলিয়ে আট মাসে মোট ১৫,০৩৪টি মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানেও ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, শুধু আগস্ট মাসেই ২২৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার, যার মধ্যে ১১৫ জন ধর্ষণ বা হত্যার শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, প্রথম আট মাসে ৫২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; এর মধ্যে ২৬৬ জনই শিশু, ২৬ জন ধর্ষণের পর নিহত, এবং ৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।

এছাড়া মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্টে যেখানে ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ৫৩টিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ১৩টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩টি ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা।
বিলম্বিত বিচারই প্রধান কারণ
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, বিচার বিলম্ব, তদন্তের দুর্বলতা ও প্রভাবশালী অপরাধীদের দায়মুক্তিই ধর্ষণের ঘটনাবৃদ্ধির মূল কারণ। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন, ফলে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়, আর বাদীপক্ষ সামাজিক হয়রানির শিকার হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মন্তব্য
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মোস্তফা কামাল বলেন,
“নানা সামাজিক ও মানসিক কারণে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।”
অন্যদিকে, মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন,
“ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তৎপর রয়েছে। তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নের চেষ্টা অব্যাহত আছে।”
উপসংহার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাস্তি নিশ্চিত না হলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাই দ্রুত তদন্ত, দ্রুত বিচার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি—এই তিনটি পদক্ষেপই ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে এখন সবচেয়ে জরুরি।
https://shorturl.fm/h7ChR