গ্রামেগঞ্জে খেজুর গাছ পরিচর্যায় চলছে শীতের প্রস্তুতি
মোঃ জাকির হোসেন
দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। হেমন্তের হাওয়ায় বইছে শীতের আগমনী বার্তা। ঝিনাইদহের মাঠে-মাঠে, গ্রাম-গঞ্জে সেই শীতের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গাছিরা। আসন্ন শীত মৌসুমে খেজুর রস ও গুড় তৈরির মহাযজ্ঞকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে খেজুর গাছের পরিচর্যা ও প্রস্তুতির কাজ।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভোর হতেই গাছিরা ঠুঙ্গি, দড়ি, বাইলধারা আর ধারালো দা নিয়ে ছুটছেন খেজুর গাছের বাগানে। দক্ষ হাতে গাছের মাথা পরিষ্কার করছেন তারা। পরে সেই গাছকে বিশ্রাম দিয়ে কয়েক সপ্তাহ পরই শুরু হবে রস সংগ্রহ।

সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের গাছি আনিছুর রহমান বলেন,
“কার্তিক মাসের শুরু থেকেই আমরা খেজুর গাছ তোলার কাজ শুরু করি। আর এক সপ্তাহ পর থেকেই রস পাওয়া শুরু হবে।”
আরেক গাছি মজিবার রহমান জানান,
“আমি প্রায় ৪৫ বছর ধরে গাছ কাটি। রস ও গুড় বিক্রি করে ভালো আয় হয়। কিন্তু এখন নতুন গাছি পাওয়া যায় না, গাছও কমে গেছে। এভাবে চললে ঝিনাইদহের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঝিনাইদহ খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের ঐতিহ্যবাহী জেলা। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া খেজুর গাছের জন্য উপযোগী হওয়ায় এখানে প্রতিবছর প্রায় ৮০০ থেকে ৮৫০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। এছাড়া জেলায় মোট ১ লাখ ৪২ হাজার ২৩৫টি খেজুর গাছ রয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজার ৭৬০টি গাছ থেকে রস আহরণ করা যায়।
প্রতি বছর এখান থেকে প্রায় ৪৮ লাখ লিটার খেজুর রস ও ৮৭২ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবদারপুর গ্রামের আনজের বিশ্বাস বলেন,
“খেজুর গুড়ের স্বাদ অন্যরকম। শীত এলে শহর-গ্রামের মানুষ আমাদের কাছ থেকে রস ও গুড় নিতে আসে। এটা আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য, দেশের ঐতিহ্য— বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”

সদর উপজেলার বারকোদালিয়া গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া বেগম বলেন,
“আগে অনেক রস হতো, এখন গাছ কমে গেছে। তবু আমরা বাইন বানিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি। রস, গুড় ও পাটালি বিক্রি করেই এ সময়টা আমাদের বাড়তি রোজগারের সুযোগ।”
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন,
“নিরাপদ উপায়ে খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনে গাছিদের প্রশিক্ষণ দিতে আমরা কাজ করছি। গত বছর অনেক গাছিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, এবারও সেই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।”

তিনি আরও জানান,
“এই বছর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৯০০ মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। জেলার প্রায় সব এলাকায় গাছিরা গাছ প্রস্তুত করেছেন। আগামী সপ্তাহেই রস সংগ্রহ শুরু হবে।”
প্রকৃতিতে শীতের ছোঁয়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনাইদহের গ্রামীণ জনপদে খেজুর রস ও গুড় তৈরির উৎসব যেন এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। গাছিদের হাতের পরশে সেই ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে, টিকে থাকুক আগামী প্রজন্মের স্মৃতিতে।