বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট মিডিয়ার সংবাদ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে : মাহবুব মোর্শেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘মুক্ত গণমাধ্যম ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট মিডিয়ার সংবাদ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিবিসি’র মতো মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো ‘মোজো’ বা মোবাইল জার্নালিজম চালু করেছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাঁচা ভিডিও বা পোস্টগুলো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

মাহবুব মোর্শেদ বলেন, জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানে মোবাইল ও অন্যান্য নন-কনভেনশনাল মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকা ছিল নজরদারির মতো। এই ধরনের আধুনিক তথ্য প্রবাহের জন্য আমরা এখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত নই। আমাদের পুরোনো, সেকেলে গণ্ডিতে আটকে থাকায় নতুন প্রজন্মের সংবাদ গ্রহণের ধরণ ও মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যেখানে নতুন প্রজন্মের কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সরাসরি ভিডিও ও পোস্টগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বেশি, সেখানে আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তোলা।

“বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ” 01612346119

তিনি বলেন, “আমরা যদি আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নেই, তবে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের জন্য বড় সংকট তৈরি হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্যের মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা ও সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। দমন-পীড়ন, নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, কারণ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম।”

মাহবুব মোর্শেদ আরও বলেন, ২০২৪ সালে নতুন বাংলাদেশ গঠন হচ্ছে, যেখানে ওপেন ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা যখন একটি প্রজন্মের ব্যবহৃত ডিভাইসকে শত্রু হিসেবে দেখি, তখন আসলে সেই প্রজন্মের সঙ্গে সংঘর্ষের পথে হাঁটছি। কিন্তু এই পথ দিয়ে দেশের মুক্তি আসবে না। আমাদের দায়িত্ব হলো, প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে একসঙ্গে এগোতে হবে।”

তিনি বলেন, কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত যেসব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মূলত মালিক, সরকার ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং যাদের সঙ্গে নৈকট্য বেশি, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে, প্রচলিত মিডিয়ার পাশাপাশি, নতুন ও উদীয়মান প্ল্যাটফর্মগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।

অতীতে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। মাহবুব মোর্শেদ উল্লেখ করেন, প্রচলিত ও নিবন্ধিত মিডিয়া অধিকাংশই আন্দোলনের খবর যথেষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেনি। অধিকাংশ টেলিভিশন এই সময়ে সরকারি প্রচারচ্যানেল ‘বিটিভি’র মতো হয়ে গিয়েছিল, যা আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদে ছিল নিরব। অন্যদিকে, অনেক গণমাধ্যমের বিরুদ্ধাচরণ ও ব্ল্যাকআউটের কারণে সাধারণ জনতা যে তথ্যপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তা স্পষ্ট। তাঁর মতে, এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর এস. এম. নসরুল কদির। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও ‘মুক্ত গণমাধ্যম ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে, যা বর্তমান প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “সৎ ও শিষ্ট থাকলে, গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের প্রকৃতি ও দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা গেলে, আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারব।”

মুখ্য আলোচক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহীদুল হক বলেন, ‘অবাধ তথ্যের মাধ্যমে কোনো অন্যায় বা অপসাংবাদিকতা রুখে দিতে হবে। অন্যের চরিত্র হরণ, অপবাদ ও মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম যেন গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’

আলোচনা সভার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর. রাজী। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ‘মুক্ত সংবাদমাধ্যম’ অপরিহার্য। গণতন্ত্রের টেকসই ভিত্তি প্রতিষ্ঠায়, মুক্ত সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তিনি বলেন, ‘মুক্ত সংবাদমাধ্যম’ ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না।

অতিথিরা আরও বলেন, স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যম একে অপরের পরিপূরক। দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে মুক্ত ও স্বচ্ছ গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আব্দুস সাত্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা আলম, এ্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সেলিম মো. জানে আলম, এডভোকেট জিয়াউ হাবীব আহসান, সিএমইউজের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, দৈনিক কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান মোস্তফা নঈম, দৈনিক ইনকিলাবের ডেপুটি ব্যুরো প্রধান রফিকুল ইসলাম সেলিম ও দৈনিক আমার দেশের ব্যুরো প্রধান সোহাগ কুমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *