ফরিদ উজ জামান
“ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার”—এই কথা এখন আর বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং একটি বিস্মৃত রাজনৈতিক স্লোগান। বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নাস্তিক, মুক্তচিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বেঁচে থাকা প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমি একজন নাস্তিক। আমি কোনও ধর্মে বিশ্বাস করি না, অলৌকিকতায় আস্থা রাখি না, যুক্তির আলোয় সত্যকে খুঁজে নিতে চাই। কিন্তু এই বিশ্বাসহীনতা আজ বাংলাদেশে একপ্রকার অপরাধে পরিণত হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইন—সবকিছু যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মৌলবাদীদের পক্ষে।
২০২৪ সালের শেষদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি ভয়ংকরভাবে পূরণ করতে শুরু করেছে ধর্মীয় উগ্রবাদ। তাঁর শাসনামলে একধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল, অন্তত মৌলবাদীদের প্রকাশ্য দাপট কিছুটা রোধ করা যেত। কিন্তু পদত্যাগের পর দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা যেন সুযোগ করে দিয়েছে হেফাজত, হিজবুত তাহরীর, তাওহিদি জনতা-র মতো সংগঠনগুলোর জন্য।
২০২৫ সালের মার্চে হিজবুত তাহরীর ঢাকার বুকে প্রকাশ্য মিছিল করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সিলেট ও নোয়াখালীর বিভিন্ন দরগায় হামলা চলে, নারীর অধিকার রক্ষায় আইন সংশোধনের বিরুদ্ধেও হেফাজতের হুমকি-বিদ্বেষমূলক ভাষণ সামনে আসে। এসব ঘটনাগুলো শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শূন্যতার সুযোগ নিয়ে উগ্র গোষ্ঠীগুলো যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তার উদাহরণ।
এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় নাস্তিকদের অবস্থা আরও ভয়ানক হয়েছে। আমি নিজে বহুবার সামাজিক মাধ্যমে হুমকি পেয়েছি। “তুই মুরতাদ”, “জবাই করে ফেলব”—এই ধরনের বার্তা শুধু আমাকে নয়, আমার পরিবারকেও আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। প্রতিবাদ করলে বলা হয়, “আপনি চুপ থাকলেই তো এসব হতো না।”
রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত ব্যর্থ। আরিফ রায়হান দ্বীপকে যারা হত্যা করেছিল, সেই চরমপন্থী নেতাকে ২০২৪ সালে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার এমন ঘটনা ঠেকাতে যতটা না পেরেছে, তাঁর শূন্যতার পরবর্তী সরকার ততটাই উদাসীন। এখন তো এসব হত্যাকারীদের রীতিমতো বীরের মতো দেখা হচ্ছে।
এই কারণেই আমি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছি। আমি আজ যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী। এখানে আমি অন্তত অবিশ্বাসের কারণে মেরে ফেলার ভয়ে ঘুমাতে হয় না। কিন্তু হৃদয়ে রয়ে গেছে হতাশা—আমার দেশের জন্য, সেই মানুষগুলোর জন্য যারা এখনো মুখ লুকিয়ে বেঁচে আছেন, কণ্ঠরোধ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছেন।
বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পর তৈরি হওয়া শূন্যতার মধ্যে যারা “ধর্মের নামে রাজনীতি” করে, তারা এখন নেতৃত্বে আসতে চায়। তাদের মধ্যে মানবতা নেই, যুক্তি নেই, আছে কেবল শাসন করার ইচ্ছা।
আমি চাই, বাংলাদেশ আবার এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, যেখানে বিশ্বাস থাকুক বা না থাকুক, সবাই বাঁচতে পারবে সমানভাবে। ধর্মের স্বাধীনতার পাশাপাশি অবিশ্বাসেরও স্বাধীনতা থাকবে। আমাদের মতো মানুষ আর মুখ লুকিয়ে বাঁচবে না—এই আশাটুকুই এখনও বুকের মাঝে পুষে রেখেছি।
নীরবতার শিকার আমরা: ধর্মীয় উগ্রবাদের ছায়ায় বাংলাদেশে নাস্তিকদের অস্তিত্ব সংকট
ফরিদ উজ জামান
“ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার”—এই কথা এখন আর বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং একটি বিস্মৃত রাজনৈতিক স্লোগান। বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নাস্তিক, মুক্তচিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বেঁচে থাকা প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমি একজন নাস্তিক। আমি কোনও ধর্মে বিশ্বাস করি না, অলৌকিকতায় আস্থা রাখি না, যুক্তির আলোয় সত্যকে খুঁজে নিতে চাই। কিন্তু এই বিশ্বাসহীনতা আজ বাংলাদেশে একপ্রকার অপরাধে পরিণত হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইন—সবকিছু যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মৌলবাদীদের পক্ষে।
২০২৪ সালের শেষদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি ভয়ংকরভাবে পূরণ করতে শুরু করেছে ধর্মীয় উগ্রবাদ। তাঁর শাসনামলে একধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল, অন্তত মৌলবাদীদের প্রকাশ্য দাপট কিছুটা রোধ করা যেত। কিন্তু পদত্যাগের পর দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা যেন সুযোগ করে দিয়েছে হেফাজত, হিজবুত তাহরীর, তাওহিদি জনতা-র মতো সংগঠনগুলোর জন্য।
২০২৫ সালের মার্চে হিজবুত তাহরীর ঢাকার বুকে প্রকাশ্য মিছিল করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সিলেট ও নোয়াখালীর বিভিন্ন দরগায় হামলা চলে, নারীর অধিকার রক্ষায় আইন সংশোধনের বিরুদ্ধেও হেফাজতের হুমকি-বিদ্বেষমূলক ভাষণ সামনে আসে। এসব ঘটনাগুলো শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শূন্যতার সুযোগ নিয়ে উগ্র গোষ্ঠীগুলো যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তার উদাহরণ।
এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় নাস্তিকদের অবস্থা আরও ভয়ানক হয়েছে। আমি নিজে বহুবার সামাজিক মাধ্যমে হুমকি পেয়েছি। “তুই মুরতাদ”, “জবাই করে ফেলব”—এই ধরনের বার্তা শুধু আমাকে নয়, আমার পরিবারকেও আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। প্রতিবাদ করলে বলা হয়, “আপনি চুপ থাকলেই তো এসব হতো না।”
রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত ব্যর্থ। আরিফ রায়হান দ্বীপকে যারা হত্যা করেছিল, সেই চরমপন্থী নেতাকে ২০২৪ সালে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার এমন ঘটনা ঠেকাতে যতটা না পেরেছে, তাঁর শূন্যতার পরবর্তী সরকার ততটাই উদাসীন। এখন তো এসব হত্যাকারীদের রীতিমতো বীরের মতো দেখা হচ্ছে।
এই কারণেই আমি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছি। আমি আজ যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী। এখানে আমি অন্তত অবিশ্বাসের কারণে মেরে ফেলার ভয়ে ঘুমাতে হয় না। কিন্তু হৃদয়ে রয়ে গেছে হতাশা—আমার দেশের জন্য, সেই মানুষগুলোর জন্য যারা এখনো মুখ লুকিয়ে বেঁচে আছেন, কণ্ঠরোধ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছেন।
বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পর তৈরি হওয়া শূন্যতার মধ্যে যারা “ধর্মের নামে রাজনীতি” করে, তারা এখন নেতৃত্বে আসতে চায়। তাদের মধ্যে মানবতা নেই, যুক্তি নেই, আছে কেবল শাসন করার ইচ্ছা।
আমি চাই, বাংলাদেশ আবার এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, যেখানে বিশ্বাস থাকুক বা না থাকুক, সবাই বাঁচতে পারবে সমানভাবে। ধর্মের স্বাধীনতার পাশাপাশি অবিশ্বাসেরও স্বাধীনতা থাকবে। আমাদের মতো মানুষ আর মুখ লুকিয়ে বাঁচবে না—এই আশাটুকুই এখনও বুকের মাঝে পুষে রেখেছি।