দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর মামলা

মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা ও জনসচেতনতায় জোর দেওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের

মোঃ জাকির হোসেন

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর ঘটনা। বিভিন্ন দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, পানিতে পড়ে বা অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ উদ্ধারের পর থানাগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৮৩টি অপমৃত্যুর মামলা (ইউডি কেস) রেকর্ড হচ্ছে। এসব মামলার মধ্যে অনেকগুলো পরবর্তীতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের থানাগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে আড়াই হাজারেরও বেশি অপমৃত্যুর মামলা হচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে ২ হাজার ৪৬০টি এবং জুনে আড়াই হাজারের বেশি মামলা রেকর্ড হয়। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ।

আত্মহত্যা—অপমৃত্যুর প্রধান কারণ

তথ্য অনুযায়ী, অপমৃত্যুর মামলার বেশিরভাগই আত্মহত্যাজনিত। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৮ শতাংশ নারী। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ গলায় ফাঁস দিয়ে, আর ২৫ শতাংশের বেশি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। বয়সভিত্তিক হিসেবে দেখা যায়, ১৮ বছরের নিচে ২৫ শতাংশ, ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৩৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ২২ শতাংশ, ৪৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী ১০ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি ৫ শতাংশ ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন।

অপমৃত্যুর সংজ্ঞা ও আইনি প্রক্রিয়া

কোনো ব্যক্তি যদি প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে মারা যান, তাকে অপমৃত্যু (Unnatural Death) বলা হয়। এসব মৃত্যুর ঘটনায় থানায় রেকর্ড হয় ইউডি মামলা (UD Case), যা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারা ও পিআরবি ২৯৯ বিধি অনুযায়ী তদন্ত করা হয়।

এই ধরনের মৃত্যুর মধ্যে পড়ে—

  • গলায় ফাঁস বা বিষপানে আত্মহত্যা
  • সাপ বা প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু
  • পাহাড় বা মাটিচাপা, নৌদুর্ঘটনা বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু
  • পানিতে ডুবে, আগুনে পুড়ে বা বজ্রপাতে মৃত্যু
  • গাছ, ছাদ বা যন্ত্রপাতি থেকে পড়ে মৃত্যু
    পুলিশ সন্দেহজনক মৃত্যু পেলে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে এবং প্রয়োজনে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠায়। ময়নাতদন্তে যদি হত্যার আলামত পাওয়া যায়, তবে অপমৃত্যুর মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মহত্যার প্রভাব

পুলিশ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার। তরুণ-তরুণীরা অনলাইনমুখী জীবনযাপনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে, যা কখনও কখনও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া, ব্লু হোয়েল, মোমোসহ কিছু অনলাইন গেমস, অনলাইন বুলিং, সম্পর্কজনিত হতাশা এবং নেতিবাচক মন্তব্য বা পোস্ট শেয়ার অনেক সময় আত্মহত্যার উদ্দীপনা বাড়ায়।

করণীয় ও প্রতিকার

পুলিশ সদর দপ্তর ইতোমধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক কর্মশালা আয়োজনের নির্দেশনা দিয়েছে। এ ছাড়া, প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে অপমৃত্যুর মামলাগুলোর বিশ্লেষণ ও প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রয়োজন—

  1. মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি
  2. স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চালু করা
  3. পরিবার ও সমাজে সহানুভূতিমূলক আচরণ নিশ্চিত করা
  4. প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার
    তারা বলেন, “আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়—এটি বোঝাতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *