নিজস্ব প্রতিবেদক
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হিমালয় অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তুলতে পানি ন্যায্যতা ও আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা জোরদারের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, পানি ন্যায্যতা, নদীর অধিকার, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং হিমালয় ঘিরে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সমতা ও সুফল বণ্টন অত্যন্ত জরুরি। আজ (শুক্রবার) নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ‘হিন্দুকুশ হিমালয়ায় পানি ও জলবায়ু সহনশীলতা’ সংক্রান্ত সাব-রিজিওনাল কর্মশালায় ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা দেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে এই অঞ্চলের পানিসংক্রান্ত বিষয়গুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উল্লেখ করেন, দীর্ঘকাল ধরে পানি সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেশগুলোকে একত্রে সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করলেও, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি এখনও সবচেয়ে কম ব্যবস্থাপিত যৌথ সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পানি কনভেনশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ডাটা বিনিময় ও আন্তঃসীমান্ত নদীর ন্যায্য বণ্টনের জন্য প্রস্তুত। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এই কনভেনশন আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা পানির সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপদেষ্টা বলেন, উপরের নদীগুলোর উপর নির্ভরশীলতা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের নদীগুলোর ওপর যা ঘটে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নদী উজান থেকে আসে, ফলে বন্যা, খরা, পলি জমা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন—এসব সমস্যা আঞ্চলিক জলপ্রবাহের প্রভাবের ফল। তিনি আরও বলেন, যদিও বেশ কিছু দেশেই জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নীতি, আইন ও সংস্থাগুলোর উপস্থিতি রয়েছে, তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি বিদ্যমান। নদী ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামোর কারণে নদীর স্বাভাবিক চর্চায় ক্ষতি হয়েছে। নদীকে শুধু উপাদান বা সম্পদ হিসেবে না দেখে, জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, নদী শুধু সেচ, নৌপরিবহন বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যম নয়, এটি জীবনের উৎস ও জীববৈচিত্র্যের ধারক। বাংলাদেশ ও ভারতের আদালত কয়েকটি রায়ের মাধ্যমে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা নদী সংরক্ষণে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, নদী সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত প্রয়োজন। পাশাপাশি, শিল্পের বর্জ্য, অবৈধ দখল, খনন ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন কার্যক্রম নদী ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলছে। বাংলাদেশে নদী পুনরুদ্ধারের উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি নেপালের উদ্যোগকেও সমর্থন জানান।
বাংলাদেশ-নেপালের পানিবিদ্যুৎ চুক্তির উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, এই সহযোগিতা আস্থা ও পরিবেশগত দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে হবে। উজানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। এই উন্নয়নশীল প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে অঞ্চলটির জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকরী হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. কল্যাণ রুদ্র, ড. দেবোলিনা কুণ্ডু ও অরবিন্দ কুমার, নেপালের সঞ্জীব বরাল, ভুটানের পেমা থিনলে, বাংলাদেশের ড. মো. আবদুল হোসেন এবং ইউথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান বক্তব্য দেন। বক্তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা, নদী রক্ষা ও পানির ন্যায্য বণ্টনের গুরুত্ব তুলে ধরে, এই উদ্যোগকে অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন।
এই কর্মশালা ও আলোচনাগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু ও পানির সংকট মোকাবিলায় অঞ্চলভিত্তিক সমঝোতা ও কাজের ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে বলে প্রত্যাশা প্রকাশ করা হয়।

01612346119