বাংলাদেশে ধর্মের নামে দমন ও উগ্র ইসলামের উত্থান: একজন সচেতন নাগরিকের পর্যবেক্ষণ

মোঃ রুম্মান হোসেন

আমার পরিচয় একজন সচেতন বাংলাদেশি নাগরিক, যার শেকড় এই দেশেই—বাংলাদেশে। আমি এই লেখাটি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির জায়গা থেকে লিখছি, যেখানে আমি প্রকাশ করছি কীভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য একটি চরম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে একটি সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখি কীভাবে প্রশ্ন না করতে হয়, কীভাবে শুধু মেনে চলতে হয়। একজন মানুষ যখন ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করে, তখন সমাজ তাকে “অবাধ্য”, “নাস্তিক” কিংবা “বিপদজনক” হিসেবে চিহ্নিত করে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও আমি দেখেছি—যদি আপনি বিশ্বাসহীন হন, কিংবা শুধু প্রশ্ন তোলেন, তাহলে আপনাকে পরিবারের ভেতরেও জায়গা দেওয়া হয় না, সমাজে তো আরও কঠিন অবস্থা।

ধর্মের নামে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এখন একপ্রকার স্বীকৃত সাংস্কৃতিক কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সীমিত করে ফেলা হয়। সমকামীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। আর যারা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন—তাদের জোটে সামাজিক বর্জন, অনলাইন হুমকি, এমনকি সহিংসতা।

এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তাতে উগ্র ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত বা ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলো ধর্মীয় আদর্শকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে মুক্তচিন্তা, নারী স্বাধীনতা, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে।

শুধু রাজনৈতিক পরিসর নয়—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি গণমাধ্যমেও এখন তাদের প্রভাব স্পষ্ট। “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” কথাটি এখন এমন এক অস্ত্র হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে তা অপরাধে পরিণত করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ব্যক্তিগত মতামত দমন করা হচ্ছে।

এমন একটি সমাজে একজন যুক্তিবাদী, মুক্তমনা বা বিশ্বাসহীন মানুষের জন্য প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। তাদের জায়গা নেই গণমাধ্যমে, নেই মঞ্চে, নেই সামাজিক সম্মানেও। অথচ একটি সভ্য, প্রগতিশীল রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হওয়া উচিত চিন্তার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার।

আমি যখন যুক্তরাজ্যে এসে শিক্ষা নিতে শুরু করি, তখন আমার দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত হয়। এখানে মানুষের মত প্রকাশ, ধর্ম নিয়ে আলোচনা, কিংবা অবিশ্বাসের স্বাধীনতা—সবকিছুই আইনি ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত। আর তখনই আমি বুঝতে পারি, আমাদের দেশে এসব মৌলিক অধিকার কতটা সংকুচিত। এটি উপলব্ধি করেই আমি লিখতে বসেছি—কারণ আমি বিশ্বাস করি, একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব শুধু শিখে যাওয়া নয়, বরং নিজের সমাজের অন্যায় ও অসংগতিকে চিহ্নিত করা এবং তা নিয়ে কথা বলা।

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয়, বরং এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখানো যেখানে বিশ্বাস, অবিশ্বাস, যুক্তি ও মানবতা—all can co-exist peacefully.

আমি চাই বাংলাদেশ একটি এমন রাষ্ট্র হয়ে উঠুক, যেখানে কেউ তার চিন্তা, ধর্ম বা বিশ্বাস নিয়ে হেয়প্রতিপন্ন হবে না। একজন নারী, একজন নাস্তিক, কিংবা একজন সংখ্যালঘু—তাদের কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে, শুধু ভিন্ন হওয়ার কারণে। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমি লিখছি।

নাস্তিকতা কোনো অপরাধ নয়। চিন্তা করা, প্রশ্ন করা, আলোচনায় অংশ নেওয়া—এসবই একটি সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ট্য। আমি চাই বাংলাদেশ এই মূল্যবোধগুলোকে শ্রদ্ধা করুক। কারণ ধর্ম মানুষকে ভালো থাকতে শেখাতে পারে, কিন্তু ধর্মের নামে মানুষকে দমন করা—এটি কোনো সভ্যতার নির্দেশ নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নামযের সময়সূচি